ডেস্ক রিপোর্ট ::
চলতি বছরের এপ্রিলেই প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা অবৈধ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। কীভাবে এই অবৈধ পাসপোর্ট সংগ্রহ করা হয়, ঢাকা ট্রিবিউনের এক সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে তা উঠে এসেছে। ওই অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দালালরা ঘুষের বিনিময়ে পাসপোর্ট অফিসের সঙ্গে যোগসাজশের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের এই অবৈধ পাসপোর্ট সংগ্রহ করে দেয়।
গত বছরের আগস্টে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রাখাইনে পূর্ব পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। অতীতেও সহিংসতা থেকে বাঁচতে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। ভুয়া পার্সপোর্টের মাধ্যমে এদের মধ্যে ঠিক কতজন এভাবে বিদেশে গেছে তার কোনও তথ্য সরকারের কাছে নেই। তবে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম গত এপ্রিল মাসে বলেছিলেন, প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বিদেশ ভ্রমণ করেছে। মন্ত্রী বলেন, এর ফলে বাংলাদেশি শ্রমিকরা ভাবমূর্তি সংকটের মুখে পড়ছে।
গত অক্টোবর থেকে কক্সবাজার পুলিশ ও জেলা প্রশাসন অবৈধভাবে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্রধারী ৩ শতাধিক রোহিঙ্গাকে খুঁজে পেয়েছেন। আর এই বছর চট্টগ্রামের দুটি পাসপোর্ট অফিসে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করার সময় ২৫০ জনের বেশি রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করা হয়। উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, তারা যে কাউকে যেকোনও নাগরিক সনদ দেওয়ার আগে ভাল করে পরীক্ষা নিচ্ছেন। কারণ রোহিঙ্গাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও চেহারা স্থানীয় বাসিন্দাদের মতোই। কক্সবাজার পুলিশ প্রধান একেএম ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি নাগরিক সনদ সংগ্রহ রোধ করতে আমরা সবসময় কাজ করছি। আমরা তাদের কঠোর নজরদারিতে রেখেছি।’ তা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের অবৈধ পাসপোর্ট সংগ্রহ বন্ধ করা যায়নি।
কাজল সওদাগর নামে ৪৫ বছর বয়সী রোহিঙ্গা লোকটি কুতুপালং ক্যাম্পে বাস করেন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে আসা কাজল বলেন, ২০০০ সালের আগে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়া বেশি সহজ ছিল। তিনি বলেন, আমি ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবে থেকেছি। এখনও আমি ভিসা পাওয়ার চেষ্টা করছি কিন্তু এটা এখন অনেক কঠিন হয়ে গেছে।
কক্সবাজারের পাসপোর্ট অফিসের একজন দালাল সুলতান আহমেদ অবৈধ পাসপোর্ট যোগাড় করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা প্রথমে আমাদের মক্কেলের সমবয়সী কয়েক স্থানীয় বাংলাদেশির আসল জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করি। এরপর ওই পরিচয়পত্র দিয়ে আমরা দূরবর্তী ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করি। পরবর্তীতে আমরা আসল পরিচয়পত্র, প্রকৃত ব্যক্তির ছবি ও জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করি।’
সুলতান জানান, তাদের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের যোগাযোগ রয়েছে। প্রকৃত ব্যক্তির ছবি ও নামধাম পরিবর্তন করে রোহিঙ্গাদের ছবি ও পরিচয় ব্যবহারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার মক্কেল (রোহিঙ্গা) পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করে ও পাসপোর্টের জন্য ছবি তোলে। অনেক কর্মকর্তা টাকার বিনিময়ে আমাদের সাহায্য করেন। কিন্তু অনেক সময় সিনিয়র কর্মকর্তারা দলিলগুলো ভালভাবে চেক করলে আমাদের মক্কেল ধরা পড়ে যায়।’
সুলতান জানান, তারা এই পুরো প্রক্রিয়ার সময় পাসপোর্ট অফিস থেকে দূরে থাকেন। আরেকজন দালাল সোহেল ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট চালুর আগে অবৈধভাবে পাসপোর্ট পাওয়া খুব সহজ ছিল। কিন্তু এখন কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির কারণে এখন তা অনেক কঠিন হয়ে গেছে।
অবৈধভাবে পাসপোর্ট যোগাড় করতে গিয়ে ধরা পড়া দুই রোহিঙ্গা নারী ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, একজন স্থানীয় স্কুল শিক্ষক তারাসহ আরও ১০ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে যোগযোগ করেছিলন। তিনি তাদের ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি জন্মনিবন্ধনপত্র দেওয়ার প্রস্তাব করেন।
একই সময় এসব রোহিঙ্গা আরেকটি পাসপোর্ট যোগাড়কারী দলের সঙ্গেও যোগাযোগ করে। তারা তাদের প্রত্যেককে ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে পাসপোর্ট পাইয়ে দেওয়ার কথা বলেন।
ঢাকা ট্রিবিউনের এক তদন্তে দেখা যায়, ওই দুই রোহিঙ্গা নারী তায়েবা ও ছেনোয়ারা নামে স্থানীয় দুই নারীর আসল জন্মনিবন্ধনপত্র ও জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করেছিলেন।
এপ্রিলেই প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বলেছিলেন, রোহিঙ্গারা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও অন্যান্য স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ভুয়া দলিলাদি জমা দিয়ে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে থাকে। এভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো আড়াই লাখ রোহিঙ্গার অনেকেই বিদেশে নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। এই বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গার বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার ঘটনায় দেশের প্রশাসনিক দুর্বলতার বিষয় উঠে এসেছে। কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসের একজন দালাল ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন যে, একটি অবৈধ পাসপোর্ট করতে ৬০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়।
ভুয়া পাসপোর্ট যোগাড় করা এক রোহিঙ্গার নাম মোশাররফ মিয়া। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ২০০১ সালে বাংলাদেশে আসে ও কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন তিনি। কয়েক মাসের মধ্যে তিনি স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে কাজ পান। এর পরের এক দশক ধরে স্থানীয় বাসিন্দা ও বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। ২০১২ সালের শেষ দিকে নিজের জন্য বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র যোগাড় করতে সক্ষম হন তিনি। তারপর বাংলাদেশি পাসপোর্ট যোগাড় করে সৌদি আরব চলে যায়।
মোশাররফের স্ত্রী খাদিজাও ২০০২ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। এখন খাদিজা ও তার দুই ছেলেরও বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে। তার দুই ছেলেই বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে আর তারা স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা করছে। খাদিজার ২৩ বছর বয়সী ছোটভাই শহিদুল্লাহ ২০১৩ সাল থেকে কক্সবাজারের একটি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করছে। তিনি বলেন, তাদের গ্রামের অনেকেই বাংলাদেশে পড়াশোনা করতে এসেছে। অনেকেই দেশে ফিরে গেছে আর আমার মতো অনেকেই বিদেশ যাওয়ার জন্য বাংলাদেশি পাসপোর্ট যোগাড়ের চেষ্টা করছে।
শহিদুল্লাহর মা ও দুই ছোট ভাই গত বছর মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে এখন বালুখালি রোহিঙ্গা শিবিরে অবস্থান করছে। তবে তারা সেখানে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করেছে। শহিদুল্লাহ বলেন, আমরা যদি একবার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করি, তাহলে আর বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা পাসপোর্ট পাবো না।
মিয়ানমারের বুথিয়াডং কিনিসি এলাকা থেকে পালিয়ে আসা আরেক রোহিঙ্গা সেলিম ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান, তিনি বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে মালয়েশিয়া ঘুরে এসেছেন। ২৯ বছর বয়সী এই যুবক বলেন, ভুয়া কাগজপত্রের কারণে মালয়েশিয়া সরকার আমাকে ফেরত পাঠিয়েছে। তিনি বলেন, স্থানীয়দের সঙ্গে ভাল যোগাযোগ থাকায় আমি বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেয়ে যাই। এখন আমি আরেকটি মুসলিম দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
পাঠকের মতামত